obaydulbc Trainer 2 years ago |
নাপিত বউয়ের মাসি এগিয়ে এসে কুসুম কুমারীকে বলল, "দেখি মা তোমার পা... নানা পায়ের তলা দেখাও, এবার মুখ তোল। মাথার ঘোমটা একেবারে ফেলে দাও! "
কুসুম একটু ইতস্তত করে কাঁচা সোনা রঙের শাড়ির ঘোমটা একেবারে খুলে অভ্যাস বসত মুখটা নিচু করল।
বিধবা তার খুব কাছে এসে ডান হাত দিয়ে থুতনি তুলে বলল, "আমার পানে চোখ তুলে চাও দেখি বাছা।"
নতুন বউ বড় বড় চোখ তুলে তার দিকে চাইল। তার এমন সুকুমারী চেহারা স্নেহের উদ্রেক না করে পারে না। বউকে নীরবে দেখতে দেখতে বিধবা তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে বলল, "কে ওখানে? কোন নির্লজ্জ্ব লোভী পরপুরুষ লুকিয়ে লুকিয়ে কুলবধুর রূপ দেখে? সাহস থাকলে সামনে এস!"
তার কথা কানে যাওয়া মাত্র কুসুম ঝট করে মুখের ওপর ঘোমটা নামিয়ে নিল।
নিস্তারিণী উঠোন থেকে সিঁড়ি দিয়ে বারান্দা ধরে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ধমকে উঠলেন, "কে? কে ওখানে? এখুনি বেরিয়ে এস বলছি!"
বারান্দার মোটা থামের আড়াল থেকে নীলমণি বেরিয়ে এলেন, "কেউ কোথাও লুকিয়ে নেই, নিজের বাড়িতে কে আবার লুকিয়ে থাকে?"
নিস্তারিণী ধমকে উঠলেন, "মেয়ে মহলে তুমি কেন এসেছ বাবা নীলু? জানো নে এটা অন্তঃপুরবাসিনীদের এলাকা?
নীলমণি উদ্ধত ভাবেই উত্তর দিলেন, "একটা প্রয়োজনেই এসেছি। রতনের মায়ের সঙ্গে আমার দরকার ছিল, সে কোথায়?"
নিস্তারিণী বুঝতে পারলেন নীলমণি মিথ্যা কথা বলছেন। তিনি তার সাহস আর নির্লজ্জতা দেখে আশ্চর্য হলেন। ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, "স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ রাতে দোরের আড়ালে একান্তে কোর বাছা, ভদ্রলোকের ঘরের পুরুষ মানুষ দিনের বেলায় গুরুজনদের সামনে পরিবারের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করে নে, তার সঙ্গে কথাও কয় নে। তুমি এখন যাও দেখি এখান থেকে।"
নাপিত বউয়ের মাসি কিন্তু একবারের জন্যও নীলমণির মুখ থেকে চোখ সরায়নি। নীলামণি তার দিকে যেন তাকাতে পারছিল না। ফণাধারী বিষাক্ত সাপের সামনে যেমন উপযুক্ত ঔষধি গুন যুক্ত শেকড় ধরলে সে ফণা নামিয়ে নেয় তেমনি করে নীলমণি এই তেজস্বিনী নারীর সামনে থেকে সরে পড়লেন।
বিধবার মুখ যেন অন্ধকার হয়ে গেল। সে কুসুমের দিকে ফিরে বলল, "আচ্ছা ঠিক আছে বউ, তুমি এবার ঘরে যাও।”
কুসুম মাথার ঘোমটা আরও ভাল ভাবে তুলে ধীরে ধীরে চলে যেতে যেতে পেছন ফিরে দেখলো। বিষণ্ন গম্ভীর মুখে বিধবা তার দিকেই চেয়ে আছে। কে জানে বাবা কপালে কি লেখা আছে, এবারে বোধহয় ব্যাটার জন্ম দেওয়া ভাগ্যে লেখা নেই। তবে এখন নাই বা হল পরে নিশ্চই ব্যাটা হবে। তবে এ কথা ঠিক, দিদি শাউরির আশায় ছাই পড়বে। ওকে হয়তো মেলা কথা শুনতে হবে। ভাসুর ঠাউর কি সত্যি সত্যিই লুকিয়ে তাকে দেখতে এসেছিলেন? কিন্তু তা কী করে হবে? তিনি তো বয়সে তার বাবার থেকেও বড়। এ কয় মাস শ্বশুর ঘর করতে গিয়ে কানা ঘুষোয় শুনেছে ভাসুর ঠাউর নাকি লোক ভাল নন। তাঁর নাকি চরিত্তিরের মেলা দোষ আছে। তাহলে তিনি কি কুসুমকে মন্দ নজরে দেখার জন্য এসেছিলেন! ছিঃ ছিঃ, লজ্জায় কুসুমের মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। ওর মনে হল তাড়াতাড়ি উঠোন ছেড়ে নিজের ঘরে যেতে পারলে যেন বেঁচে যায়।
নীলমণির আচরণে ক্ষুব্ধ নিস্তারিণী কিছু সময়ের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। কুসুমকে একা একা নিজের ঘরের দিকে হেঁটে যেতে দেখে গলা তুলে ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবিকে ডাকলেন। সে এসে
যত্ন করে কুসুমকে ধরে তার ঘরে নিয়ে গেল।
ওরা চলে যাবার পর নিস্তারিণী বিধবা সাধিকাকে প্রশ্ন করলেন, "বউয়ের কপালে কী দেখলে গো মা, ছেলে হবে না মেয়ে?
বিধবা বেজার মুখে বলল, "আজ আর কিছুই বলব নে, মনটা বড়ই অপবিত্র লাগছে। আজ ফিরে যাই মা, ধ্যানে বসতে হবে। এর পর যেদিন আসব বিমল দিয়ে খবর পাঠাব। সেদিন চাদ্দিকে গঙ্গা জল ছড়া দিয়ে রেখ। এ বাড়ির বাতাস বড় অপবিত্র, হরি হরি। আজ যাই।"
নিস্তারিণী ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, "ছেলে পুলের সংসার আমার, এ বাড়িতে নারায়ণের নিত্য সেবা হয়। এমন করে বলছ কেন মেয়ে?"
ফিরে যাওয়ার জন্য মোক্ষদা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে নিস্তারিণীর অভিযোগ শুনে সে ফিরে দাঁড়াল, নারায়ণ কি সব সময় শিলায় অবস্থান করেন গো মা? তুমি কি কিছুই বোঝ নে? পাপের তাপ কত জান? নিজের চোখে দেখতে চাও?"
এই বলে সে বাতাসে হাত ঘুরিয়ে রক্তাভ করতল নিস্তারিণীর সামনে মেলে ধরল, তার হাতে এক মুঠো সর্ষে। তারপর এগিয়ে গিয়ে যে থামের আড়ালে নীলমণি দাঁড়িয়ে ছিল দূর থেকে সেখানে সর্ষে গুলো ছুঁড়ে দিল। গরম কড়াইতে সর্ষে দিলে সেগুলো যেমন করে ফুটে লাফাতে থাকে ঠিক সেরকম হল।
নিস্তারিণী শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন।
সাধিকা ফিরে যাওয়ার আগে সাবধান করে দিয়ে গেল, "এ বাড়ির ছোট ছেলে আর ছোট বউয়ের বড় বিপদ গো মা, সব্বক্ষন তাদের চোখে চোখে রাখবে।"
সাধিকা বিমলার সঙ্গে এলেও ফেরার সময় একাই ফিরে গেল। জমিদার বাড়ির কিশোরী বউটির কপাল ভাল নয়। ওকে চার পাশে থেকে মৃত্যুর ছায়া ঘিরে আছে। মৃত্যু তো অসম্ভাবি, যে কোন বয়সে যে কেউই মৃত্যুর কবলে পড়তে পারে। যে যার আয়ু নিয়ে জন্মায়। সে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই কিন্তু এ মেয়েটির মৃত্যু যেন বড় অপমানের, বড় নিষ্ঠুর, বড়ই নির্মম। কত জন্ম ধরে সে সাধনা করে চলেছে কে জানে। জাগতিক সব ব্যাপারে সে নিস্পৃহ তবুও লক্ষ্মী প্রতিমার মতো এই বালিকার কপালে এতো দুঃখ দেখে মনটা ভার হল কেন কে জানে!
রাধারমণ ওর কপাল এমন ভাবে কেন লিখেছেন বোঝা দুষ্কর! গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে এসেছে। পথ ঘাটে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। গৃহস্থের তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে গৃহবধূরা শাঁখে ফুঁ দিচ্ছে। তার নিজের কুটিরে রাধারমণ সন্ধের পূজা পাননি। চিন্তিত সাধিকা পা চালালেন। এখনো এক ক্রোশ পথ চলা বাকি। আকাশের এক কোণে ধ্রুবতারা দেখা দিল। ধীরে ধীরে সমস্ত আকাশ আলো নিভিয়ে দিয়ে অজস্র হীরের কুচি দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে তুলল। আজ চাঁদ উঠবে শেষ রাতে। সে দিকে চেয়ে নিজের মনে হেসে উঠলেন সাধিকা। এই সীমাহীন বিশ্বে মানুষের অস্তিত্বের আর কতটুকু দাম আছে। এই জগতে কত জনের দুঃখে সে দুঃখী হবে, কার কার সুখে সুখী হবে? ঈশ্বর নির্গুণ, নির্বিকার। মনটা হটাৎ উদাস হয়ে গেল, গুন গুন করে হরি নাম গাইতে গাইতে পথ চলতে লাগলেন।
অন্দরমহলে এই নিয়ে কানাকানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিমলার মাসি কতক্ষণ আগে ফিরে গেছে কেউ জানতে পারেনি। ঘন্টার পর ঘন্টা তো কেউ ঘরে আটকে থাকতে পারে না। কৌতুহল বসত কেউ একজন বাইরে এসে দেখল উঠোনে আর কেউ নেই। সন্ধে দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুর ঘরে পুরোহিতের পুজোর জোগাড়ও করতে হবে বলে একে একে মেয়ে বউরা বের হয়ে আসল। সবার মনে একই প্রশ্ন মেয়েছেলে গণক্কার নতুন বউয়ের ব্যাপারে কী বলে গেল। কিন্তু সে কৌতুহল মেটানোর তো কোন উপায় নেই। নতুন বউয়ের সঙ্গে সবি ঝি সর্বদা লেজ হয়ে থাকে। তাকে কিছু প্রশ্ন করলে নিস্তারিণীর কানে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর তিনি এই কৌতূহল মোটেই পছন্দ করবেন না। কিন্তু রতনমণি চিরকালই স্বভাবে ডাকাবুকো। তার ওপর সে আবার এ বাড়ির বড় মেয়ে। নিস্তারিণীকে সমীহ করলেও ভয়ে গর্তে সেঁধিয়ে যায় না। স্বামীকে তার ঘরেই জল খাবার খেতে দেওয়া হয়েছে দেখে নিশ্চিন্ত মনে কুসুম কুমারীর কাছে চলল। কে কবে তার কানে কানে খবর দেবে সে অপেক্ষায় বসে থাকলে তার অন্তত চলে না। রুপোর ডাবর থেকে কম চুন, এলাচ, লবঙ্গ আরও অনেক মশলা দেওয়া একটা পানের খিলি মুখে ঠেলে ঢাকাই শাড়ির আঁচলে দেরাজের চাবির গোছা বেঁধে সেটা পিঠের দিকে ফেলে কুসুমের ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
ক্রমশ
............
পরবর্তী পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন
বউ ডুবির কথা (৫) ..........
Alert message goes here